বোদল্যারের ‘লিপিকা’ আস্বাদনের আগে বুঝতে হবে ‘লিপিকা’ বলতে ঠিক কী বোঝায়। ‘লিপি’ শব্দটি সংস্কৃতে বোঝায় লিখিতাক্ষর পত্রাদি, বর্ণ, লেখন, প্রভৃতিকে। এখানে বিশেষ লক্ষণীয় হল ‘বর্ণ’ অর্থে ‘লিপি’ শব্দটির পর্য্যাবসান। ‘বর্ণ’ যেহেতু এইস্থলে কোন নির্দ্দিষ্টার্থের জ্ঞাপক নয়, তাই বর্ণ বলতে আমরা যেকোন বর্ণ বা রং-কেই গ্রহণ করতে পারি। অন্যথা, অব্যাপ্তিদোষ অনিবার্য্য। বর্ণ শব্দটির এইরূপ অর্থের অনির্দ্দিষ্টীকরণ বিশেষ তাৎপর্য্যপূর্ণ। ‘বর্ণ’ আবার কোন বস্তুর বহিরাঙ্গের (outward form or pattern)-এর দ্যোতক। তাই ‘লিপিকা’ সেইরকম এক সাহিত্যকৃতি যা একদিকে যেমন অনির্দ্দিষ্টবর্ণ, তেমনই অপরপক্ষে বহুমাত্রিকতার পরিজ্ঞাপক। তাই বহিরাঙ্গের বা রীতির দিক থেকেও ‘লিপিকার’ প্রচলিত সাহিত্যরীতিসমূহে (গদ্যই হোক্ বা পদ্য) অন্তর্ভুক্তিকরণ সর্বদা অনুচিত। ‘লিপিকা’ স্বয়ং একটি সাহিত্যরীতি বা literary form।
‘কবিতিকা’ যেমন রবীন্দ্রনাথের একটি স্বনির্মিত শব্দ [দ্রঃ Introduction, (p.3) Particles, Jottings, Sparks, by William Radice, Harper Collins, 2000], তেমনই ‘লিপিকা’ শব্দটিও তাঁর একটি নির্মিতি বলে আমাদের ধারণা। এই দুয়ের মধ্যে সাদৃশ্য শব্দদুটির অন্তস্থিত ‘কা’ অংশটিতে, যা সংক্ষিপ্ততার অভিজ্ঞাপক। তাই ‘লিপিকা’ রীতিতে রচিত সাহিত্যের অভিজ্ঞান তার সংক্ষিপ্তাবয়বে নিহিত। কিন্তু যেহেতু এটি অনির্দ্দিষ্টবর্ণ তাই এর মধ্যে কাব্যময়তার পাশাপাশি গদ্যের ছন্দোমাধুরীও বিদ্যমান - এটি গদ্যমাধুরীবিশিষ্ট কাব্যময় লেখনমাত্র, এককভাবে গদ্যও নয়, কবিতাও নয়, আর এখানেই তার অভিনবত্ব ও অ-পূর্বত্ব। তাই আমাদের মতে, রবীন্দ্রনাথের ‘লিপিকা’-র স্থান হওয়া উচিত রবীন্দ্ররচনাবলীর কাব্যখণ্ডগুলিতেও নয়, গদ্যখণ্ডগুলিতেও নয়, বরং একটি স্বতন্ত্র খণ্ডে বা ‘বিবিধ’ খণ্ডে।
No comments:
Post a Comment